আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ)
শীতের পিঠাপুলি”- বাঙালীর আদি ঐতিহ্য
আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ)
“পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশীতে বিষম খেয়ে/ আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে। বাংলাদেশের বিখ্যাত কবি বেগম সুফিয়া কামাল পিঠাকে নিয়ে এমন বর্ণনা লিখেছেন পল্লী মায়ের কোল কবিতায়। শীতকালে বাঙালীর পিঠা ছাড়া একেবারেই বেমানান। শহুরে জীবনে শীতের সময়টায় হোটেল রেস্তোরাগুলোতে প্রায় সকল ধরনের পিঠা বিক্রি শুরু হয়। পৌষ মাস পড়লেই বিভিন্ন সংগঠনের পিঠা উৎসবের মাতামাতি পড়ে যায়। তবে পিঠা উৎসবে বাঙালীর চিরন্তন সত্ত্বাটুকু হারিয়ে যায়নি। এর আধুনিক সংষ্করন ও বাণিজ্যিকরণের পরিধি বেড়েছে। বাঙালীর পিঠা এখন দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বের প্রায় ৮০ টি দেশে পৌঁছেছে। বাংলাদেশে প্রায় দেড়শ’ রকমের পিঠা তৈরি হয়। একেক পিঠা তৈরি হয় একেক ধরনের উপাদানে। চিতই পিঠা, ভাঁপা পিঠা, পাটি সাপটা, ফুল পিঠা, দুধ পিঠা, জামাই পিঠা, পাতা পিঠা, বিবিখানা পিঠা, সাজ পিঠা, তাল পিঠা, পাটা পিঠা, মুঠা পিঠা, লবঙ্গ পিঠা, ছিট পিঠা, চষি পিঠা, ঝাল পিঠা, মালাই পিঠা, মুঠি পিঠা, জামদানি পিঠা, ক্ষীরকুলি, লবঙ্গ লতিকা, ঝুড়ি পিঠা, ফুলকুচি পিঠা ছাড়াও বাহারি নামের আরো অনেক পিঠা রয়েছে।
বছর কয়েক আগেও খেজুরের রস ও গুড় ছাড়া শীতের পিঠাপুলি ভাবা ছিল নিতান্তই অপ্রকৃত ব্যাপার। কুয়াশা ঘেরা সকালে গাছ থেকে নামানো কাঁচা রসের স্বাদ যেমন বর্ণনায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়, তেমনি জ্বাল করা রসের এবং গুড়ের তৈরি বিভিন্ন খাবারের স্বাদ ও চাহিদা ছিল ঢের। কাঁচা রসের তৈরি পায়েসের গন্ধটা বেশ উপভোগ্য। বাড়ির আঙিনায় মাটির চুলার ওপর মাটির হাঁড়িতে পিঠা বানানোর যে দৃশ্য, তা এখন আর সহসা চোখে পড়ে না। কুয়াশা মোড়ানো শীতের হিমেল হাওয়ায় ধোয়া উঠা ‘ভাঁপা’ পিঠার স্বাদ না নিলে বাঙালীর তৃপ্তি যেন মেটেই না। পরিবারের সবাই মিলে গল্পচ্ছলে গ্রাম-বাংলায় সেই রসালো পিঠা-পায়েস খাওয়ার উৎসব রীতি এখন অনেকটাই ম্লান।
একসময়ে পৌষ মাস ছিল বাঙালির পিঠে-উৎসবের মাস। শহর থেকে গ্রাম এই উৎসব তখন চলত সবখানেই। তখনও যৌথ পরিবারে ভাঙন ধরেনি। একটা সময়ের পরে আস্তে আস্তে এই ছবিটা বদলাতে শুরু করল। সবার প্রথমে আর্থসামাজিক বদলের ছোঁয়া লাগল মাল্টিসিটিগুলোয়। সেখান থেকে বিশ্বায়নের ঢেউ এসে পৌঁছল শহরে। তার প্রভাব পড়ল গ্রামজীবনেও। ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করল যৌথপরিবার। পিঠে-পুলির চর্চা ক্রমশ অবসৃত হতে থাকল। পিঠে তৈরির মূল কারিগর যাঁরা, তাঁদের বিরাট একটা অংশ পিঠে-পর্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হল বাঙালির মধুমেহ রোগ বা ‘সুগার’ এবং ‘ডায়েট কন্ট্রোল’ আর দেহ ঠিক রাখার জন্যে মিষ্টির প্রতি অনীহা। সব মিলিয়ে শহর থেকে গ্রাম অনেকটা ম্লান হয়ে গেল পৌষপার্বণের একান্নবর্তী উৎসবের আবহ।
সময়ের পরিবর্তনে প্রায় হারিয়েই যাচ্ছে এসব ঐতিহ্য। প্রতি বাড়িতে সকাল বেলা খেজুরের রসে ভেজানো পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ত। নিজের বাড়ির সদস্য ছাড়াও জামাই-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশী সবাই মিলে এক আসরে বসে চলত পিঠা খাওয়ার মহোৎসব। অতীতে সামাজিকতার অঙ্গও ছিল পিঠা। বউ-ঝিরা নাইওর যেতে-আসতে তৈরি করে নিতেন পিঠা। মনোহর এবং রসনা তৃপ্তিকর পিঠা তৈরির কলাকৌশল ছিল আভিজাত্যের পরিচায়ক। বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে কত প্রকার পিঠা এসেছে, পাড়ার মহিলারা জড়ো হয়ে দেখতেন। নমুনা হিসেবে প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে তা পাঠানো হতো। মাটির হাঁড়িতে রসের পিঠা ভরে রশি বেঁধে কাগজে মুড়ে ছোট ভাই রওনা দেয় না বোনের বাড়িতে! বোন পথ চেয়ে থাকে, ভাই আসছে সরিষা ক্ষেত মাড়িয়ে গুটি গুটি পায়ে। আধুনিককালের মতো চা- বিস্কুট আর রেডিমেড মিষ্টির ছড়াছড়ি ছিল না। এখন আর কেউ অপেক্ষাও করে থাকে না পিঠার জন্য।
নিজেদের আদি ঐতিহ্য অব্যাহত রাখতে মানিকগঞ্জসহ দেশের সর্বত্রই গ্রামাঞ্চলের চলছে পিঠা তৈরি ও খাওয়ার আয়োজন, তবে দিন দিন তার পরিমান কমে আসছে আশংকাজনক হারে। এ ছাড়াও ক্রেতাদের চাহিদার কারণে বিভিন্ন জনবহুল স্থানে মওসুমি ব্যবসায়ীরা ভাঁপা পিঠার পাশাপাশি চিতই পিঠা, পোয়া পিঠাসহ নানা রকমের দোকান নিয়ে বসেছেন। শীতের সকাল কিংবা সন্ধ্যায় হাওয়ায় ভাসছে এসব পিঠার ঘ্রাণ।
শীতে বাঙ্গালীর ঐতিহ্যের খাবারের মধ্যে চিতই পিঠা অন্যতম। চুলা থেকে সদ্য নামানো গরম গরম ধোঁয়া ওঠা চিতই পিঠার স্বাদও কিন্তু অসাধারণ। আর তার সঙ্গে যদি ধনেপাতার চাটনি বা মাংসের ঝোল হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। এছাড়াও মানিকগঞ্জে জামাই-মেয়ে কিংবা আত্নীয় স্বজন বেড়াতে এলে তাদের গোশত আর চিতই পিঠা পরিবেশনের রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। এই চিতই পিঠাই আবার সারা রাত দুধ আর গুড়ের রসে ডুবিয়ে রেখে বানানো হয় দুধ চিতই বা রস পিঠা। সারা রাত রসে ডুবে একেকটা পিঠা ফুলে রসে টসটসে হয়ে যায়। সকালবেলা এ পিঠার এক টুকরো মুখে ভরলেই পুরো মুখ মিস্টি রসে ভরে যায়। এই পিঠার বেশ কদর রয়েছে মানিকগঞ্জে।
ঘিওর বাসস্ট্যান্ডের অস্থায়ী পিঠা বিক্রেতা রাহিমা বেগম জানান, ছোট গোল বাটিতে চালের গুঁড়া দিয়ে তারপর খেজুর অথবা আখের গুড় দিয়ে আবার চালের গুঁড়া দিয়ে বাটি পাতলা কাপড়ে পেঁচিয়ে ঢাকনার ছিদ্রের মাঝখানে বসিয়ে দেয়া হয়। ২-৩ মিনিট ভাঁপে রেখে সিদ্ধ হয়ে তৈরি হয় মজাদার ভাঁপা পিঠা। প্রতিটি ভাঁপা পিঠা বিক্রি হয় ১০ থেকে ২০ টাকায়।
আগে শীতের এই পিঠা উৎসবকে কেন্দ্র করে বাড়ি বাড়ি মহাধুম পড়ে যেতো। গ্রামের প্রায় প্রতি বাড়িতে আসতো জামাই-ঝি, নতুন কুটুম আর বিয়াই-বিয়াইনসহ আত্মীয়স্বজন এবং দূরদূরান্তে অবস্থান করা পরিবারের সদস্যরা । আগের মতো গাঁও-প্রামে বাড়ি বাড়ি এখন আর পিঠা উৎসব হয় না। ঘিওরের রাথুরা গ্রামের জাহেরা বেগম বলেন, শীতের পিঠা খাওয়াতে মেয়ে ও জামাইদের দাওয়াত করে এনেছি। ছেলে সপরিবারে থাকে গাজীপুরে। তাদেরও ফোন করে বাড়িতে এনেছি। বছরের একটি দিন সবাই মিলে পিঠা পায়েশ না খেলে মন ভরে না।
পিঠাপুলির সঙ্গে বাঙালীর এই মিলনমেলা ইতিহাস সেই প্রাগতৈহাসিক। এখন সবই যান্ত্রিকতার মোড়কে মিশে গেছে। তারপরও শীতের আগমনে পিঠাপুলির নিমন্ত্রণ চিরন্তন হয়েই থাকবে।
Posted ৫:০৯ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০
desh24.com.bd | azad